- 08 July, 2023
- 0 Comment(s)
- 265 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
মণিকুন্তলা সেনের ইতিহাস বিস্মৃতির অতলে গিয়েছে। কেবল সেদিন বিভিন্ন সংবাদপত্রের পাতা ওলটাতে গিয়ে বিশেষ একটি সংখ্যার উপর চোখ আটকিয়ে গেল হঠাৎ। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একসময়ে মাঝে মাঝেই ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির কথা বলে এসেছেন। এই ৫ ট্রিলিয়ন সংখ্যাটিকে ভারতীয় পদ্ধতি অনুসারে হিসেব করতে চাইলে তা দাঁড়াবে ৫ লক্ষ কোটি ডলারের সমতুল। অর্থাৎ কিনা ১ ট্রিলিয়ন ডলার = ১ লক্ষ কোটি ডলার, যা কি না ভারতীয় মুদ্রায় আনুমানিক ৮০ লক্ষ কোটি টাকার কাছাকাছি। সেই সংখ্যাটির উপরে চোখ আটকিয়ে গিয়েছিল কারণ, সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় নাকি তথ্য উঠে এসেছে, ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল অবধি আমাদের দেশে পণপ্রথার কারণে, স্রেফ পণেরই জন্য কন্যাপক্ষকে গুণাগার দিতে হয়েছে প্রায় সিকি ট্রিলিয়ন ডলার অর্থাৎ কি না ভারতীয় মুদ্রায়, প্রায় ২০ লক্ষ কোটি টাকা। সংখ্যাটিকে হজম করতে বেশ খানিক সময় লেগে গেল। ১৯৬১ সাল থেকে পণপ্রথা বিরোধী আইন ভারতে জারি রয়েছে। এমনকি সেই আইনের অপব্যবহারের অবধি পর্যাপ্ত উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু সু-ব্যবহারের ক্ষেত্রে কি তাহলে এতটাই খামতি থেকে গিয়েছে? সংখ্যার চেয়ে নিষ্ঠুর, আবেগশূন্য বস্তু বড় একটা নেই। একবার যদি খাতায় কলমে অক্ষরের বদলে অঙ্কের হিসেবে কোনও একটি ফলাফলকে তুলে দেওয়া যায়, তাহলে সেই অঙ্কের ভার অক্ষরের চেয়ে অনেকগুণে বেশি হয়েই আমাদের কাঁধের উপরে এসে পড়ে। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা সেই ভারকে পিঠ বা মন থেকে নামিয়ে দিতে চেষ্টা করি। অস্বস্তিকে ঢেকে নিতে চাই অবহেলায়।
তবুও আজকের প্রবন্ধটিতে অক্ষরের চেয়ে সংখ্যার উপরেই বেশি ভরসা রাখতে চাইব। যেমন কি না, অন্য একটি গবেষণাপত্রের ফলাফল বা সমীক্ষা-রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, গ্রামীণ এলাকায় ১৯৬০ সাল থেকে ২০০৮ সাল অবধি গবেষকেরা মোট ৪০,০০০ সংখ্যক বিবাহ অনুষ্ঠানের বিষয়ে সমীক্ষা চালিয়েছিলেন। এর মধ্যে ৯৫% ক্ষেত্রেই পণপ্রদানের উল্লেখ বা প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। গবেষকেরা লক্ষ্য করেছেন ১৯৭৫ সাল থেকে ২০০০ সাল ও তার পরবর্তীতেও, গড় পণের পরিমাণ আশ্চর্যজনক ভাবে মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে প্রায় সমহারে বৃদ্ধি পেয়ে এসেছে। এই বিরাট সময়কালের উপর, এতগুলি সংখ্যক বিবাহ অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে পণের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে তাঁরা দেখেছেন, গড়ে পাত্রপক্ষের তরফে কন্যাপক্ষের উদ্দেশ্যে দেওয়া উপহারের মূল্য থেকেছে প্রায় ৫০০০ টাকার কাছাকাছি। এর বিপরীতে কন্যাপক্ষের তরফে পাত্রপক্ষকে দেওয়া উপহারের গড় মূল্য দেখা গিয়েছে প্রায় ৩২,০০০ টাকারও বেশি, অর্থাৎ কি না কন্যাপক্ষকে পাত্রপক্ষের তুলনায় প্রায় সাতগুণেরও বেশি পরিমাণে অর্থব্যয় করতে হয়েছে। তথ্য আরও বলছে ২০০৭ সালের হিসেব অনুযায়ী, গড়ে একটি পরিবারের যে বার্ষিক আয়, কন্যাদায়গ্রস্ত হলে পরে তার প্রায় ১৪%ই সেই পরিবার, বিবাহের উদ্দেশ্যে কন্যাপণের পিছনে খরচ করতে বাধ্য হয়েছেন। পণপ্রথার এই ভয়াবহ চিত্র প্রায় কোনও ভাবেই সামনে আসতে পারেনি কারণ, গ্রামীণ ভারতবর্ষে এখনও ৯০% বিবাহের ক্ষেত্রেই বাড়ির বড়রা কন্যার জন্য উপযুক্ত পাত্র নির্ধারণ করেন। ৭৮.৩% বিবাহের ক্ষেত্রে মহিলারা একই জেলার কোনও পুরুষকে বিবাহ করেন (অথবা করতে বাধ্য হন)।
অনেকে বলতেই পারেন, ১৯৯০ অথবা ’৯৯, বা সেই সূত্রে দেখলে ২০০৮ সাল থেকে আজ অবধিও আমরা অনেকখানি সময় পেরিয়ে এসেছি। সেই ক্ষেত্রে আমরা রাষ্ট্রপুঞ্জ বা ন্যাশনাল ক্রাইম রিসার্চ ব্যুরো বা এনসিআরবি’র কিছু তথ্যের উপরেও আমাদের নজর ফেরাতে পারি। রাষ্ট্রপুঞ্জের তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর এখনও, আতঙ্কিত হবেন না, আমাদের দেশে অন্ততপক্ষে ৪,০০,০০০ কন্যাভ্রূণ নষ্ট করা হয়ে থাকে। সারা পৃথিবীর হিসেব অনুযায়ী কেবল ভারত ও চীন, সারা পৃথিবীর মোট কন্যাভ্রূণ হত্যার ৯০%এর অংশীদার। এই অবস্থা জারি থাকলে পরে, (যা হয়তো নিশ্চিত ভাবেই থাকবে) – ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের দেশে অন্ততপক্ষে ৬৮ লক্ষ কন্যাসন্তান কম জন্ম নেবে। পুরুষ-নারীর অনুপাতের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখাটা যে কতখানি কঠিন হয়ে দাঁড়াতে চলেছে তা সহজেই অনুমেয়। ন্যাশনাল ক্রাইম রিসার্চ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সাল অবধি মোট ৩৫,৪৯৩টি বধূহত্যার অভিযোগ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দায়ের করা হয়েছে। অর্থাৎ, গড়ে দিনপ্রতি ২০টি বধূহত্যার ঘটনা। মনে রাখতে হবে গ্রামীণ এলাকাতে কন্যাপক্ষের তরফে অভিযোগ দায়ের করতে পারাটাও কিন্তু সময়সাপেক্ষ ও সাহস-সাপেক্ষ ব্যাপার। ‘বেটি পড়াও’এর ভারতে আমরা আক্ষরিক ভাবেই, অঙ্কের হিসেবে রেকর্ডের উপরে রেকর্ড স্থাপন করে চলেছি।
অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই, কন্যাভ্রূণ হত্যায় সবচেয়ে উপরে রয়েছে রামরাজত্ব উত্তরপ্রদেশ। পুরুষোত্তমের ঐতিহ্য মেনে নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে বরাবর গণ্য করে আসা এরাজ্যের ধর্মপ্রাণ পুরুষ-পুঙ্গবদের দাপাদাপির কারণে, ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের দেশে যে ৬৮ লক্ষ কম সংখ্যায় নারীর জন্ম ঘটবে, তার মধ্যে ২০লক্ষ ভ্রূণেরই দায় থাকবে উত্তরপ্রদেশের। এর ঠিক পিছনেই গর্বের সঙ্গে অবস্থান করছে রাজস্থান। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে যে রাজ্যে পুরুষ-নারীর সংখ্যার অনুপাত ১০০০এর বিপরীতে মাত্র ৮৮৮জন। পরে পরে জায়গা করে নিয়েছে বিহার ও ঝাড়খণ্ড। মুখ বাঁচাতে বলার মতো বিষয় কেবল একটিই, যে কয়েকটি রাজ্যে গড় প্রদত্ত পণের পরিমাণ ১৯৬০ থেকে ১৯৯৯ সালের মধ্যে কমতে পেরেছে, সেগুলি হলো ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু ও মহারাষ্ট্র। তথ্যের নিরিখে মোটামুটি এই দাঁড়িয়েছে আমাদের ‘মাতৃ’ভূমির মা’য়েদের অবস্থা। গর্বের আর শেষ থাকছে না বোধহয়?
প্রশ্ন হচ্ছে, এই সবকিছুরই সমাধান কোথায়? অঙ্কের ভার যদি বা সত্যি করেই মানুষের মনের উপরে বেশি করে পড়ে, তারপরেও তো তাঁদের এড়িয়ে যাবার প্রবণতা থেকে মুক্তি নেই। আমরা কেবল বারংবারে লিখতে পারি, মানুষকে সচেতন করতে প্রচার চালাতে পারি। কিন্তু উল্লেখ করে আসা, ২০ লক্ষ কোটি টাকার হিসেব, অথবা গড়ে বছরে ৪ লক্ষ সংখ্যাতে কন্যাভ্রূণ নষ্টের খতিয়ান, এতে বোধহয় কেবল শুকনো অপমান বা অপরাধবোধই নয়, জাতি হিসেবে আমাদের ভয়ে-লজ্জাতে, ঘৃণায় কুঁকড়ে আসা উচিত। কিন্তু পুরুষোত্তম হিসেবে আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যে কাপুরুষ ব্যক্তিকে পূজার আসনে বসায়, নিজস্ত্রীর প্রতি তাঁর আচরণ যতদিন না দেশের সংখ্যাগুরুরা নিন্দার্হ বলে মানতে শিখবে, ততদিন অবধি বোধহয় এদেশে নারীর সম্মানের আসন মিলবে না।
সূত্রঃ
[১] https://www.bbc.com/news/world-asia-india-66084575
[২] https://www.bbc.com/news/world-asia-india-57677253
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment